Wednesday, January 27, 2010

২১ বছর পর মামলা ৩৪ বছর পর দায়মুক্ত জাতি

২১ বছর পর মামলা ৩৪ বছর পর দায়মুক্ত জাতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। পথপরিক্রমায় সময় লেগেছে দীর্ঘ ৩৪ বছর। তবু শেষমেশ স্বস্তি পেয়েছে জাতি। দায় থেকে মুক্ত হয়েছে গতকাল বুধবার।
শুরুতে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশের জন্য বিচার কার্যক্রম বন্ধ ছিল ২১ বছর। তবে মামলার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। মামলা দায়ের করার পরও বিচার শেষ করতে লেগেছে ১৩ বছর। নিম্ন আদালতে বিচারকের অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে বিচারে বিলম্ব হয়। মামলার চার্জ গঠনসহ প্রতিটি বিষয় হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করায় তৈরি হয় ধীরগতি।
২০০১ সালে হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ের পর বিচারপতিদের বিব্রতবোধ হওয়া বিচারক স্বল্পতার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে আপিলের শুনানি স্থবির হয়ে পড়ে।
ঘটনা তথ্য বিশ্লেষণ করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থেমে থেমে চলা এই মামলার কার্যক্রমের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট: সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর: তত্কালীন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। উদ্যোগ নেওয়া হয় অধ্যাদেশটি বাতিলের।
আসামি গ্রেপ্তার শুরু: ১৯৯৬ সালের ১৩ আগস্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনে আসামি সৈয়দ ফারুক রহমানসহ তিন আসামি গ্রেপ্তার হন। অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল পাস হয়।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি: মামলার অভিযোগপত্র দাখিল। আসামি করা হয় বিশ জনকে। মারা যাওয়ায় চারজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরও একজন অব্যাহতি পান। ২০ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তদের মুখ্য মহানগর আদালতে হাজিরা করা হয়। মার্চ মামলা ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাস গঠন করা হয়। বিচারক কাজী গোলাম রসুল। সিরাজুল হক রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি নিযুক্ত হন। ১২ মার্চ ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে বিচার শুরু হয়।
ওই বছরের এপ্রিল ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। ২১ এপ্রিল বিচারকের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলে শুনানি স্থগিত হয়ে যায়। ২৯ এপ্রিল মোশন খারিজের পর আবার বিচার শুরু হয়।
মে পলাতক এক আসামির স্ত্রী জোবায়েদা রশিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করায় বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। ১৯ জুন জোবায়েদা রশিদের আবেদনে হাইকোর্টে নিস্পত্তি হয়নি বলে মামলার কার্যক্রম তৃতীয়বারের মতো স্থগিত হয়। কয়েকদিনের ব্যবধানে হাইকোর্ট জোবায়েদা রশিদকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে ১৯ জন আসামির বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। জুলাই সাক্ষ্য, জবানবন্দি জেরা শুরু হয়।
১৯৯৮ সালের মার্চ: ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরনের বিরুদ্ধে আপত্তি মামলা হাইকোর্ট খারিজ করে দেন। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা চালিয়ে যেতে সব বাধা অপসারিত হয়। ২০ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।
একই বছরের ১২ আগস্ট সাওয়াল জবাব শুরু এবং
১৩ অক্টোবর শেষ হয়। দেড় দিনের মতো শুনানির পর নভেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষণা হয়।
নভেম্বর: কাজী গোলাম রসুল রায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ১৯ আসামির মধ্যে খালাস দেওয়া হয়- তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ক্যাপ্টেন আব্দুল ওয়াব জোয়ার্দার, দফাদার মারফত আলী শাহ এলডি আবুল হাশেম মৃধাকে। ওইদিনই অপর আসামি বজলুল হুদাকে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় আনা হয়।
১১ নভেম্বর: হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের জন্য পাঠানো হয় মামলা।
২০০০ সালের ৩০ মার্চ: ডেথ রেফারেন্স আসামিদের আপিল শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত হয়। এপ্রিল পলাতক আসামিদের জন্য রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই বছরের ১০ এপ্রিল এক বিচারপতি শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। ১৮ এপ্রিল বিচারকদের বিব্রতবোধ হওয়ার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিমিছিল করেন। ২৪ এপ্রিল হাইকোর্টের অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চও বিব্রতবোধ করেন।
মে ১১ জন পলাতক আসামিদের জন্য রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। মে সংশোধিত পেপারবুক তৈরির আবেদন নাকচ করে সম্পূরক পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১০ জুলাই সম্পূরক পেপারবুক আদালতে জমা হয়। ১৮ জুলাই পেপারবুক পাঠ শেষে রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়।
১৪ ডিসেম্বর বিভক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। এক বিচারপতি পনের জনের মধ্যে দশ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপর বিচারপতি ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
২০০১ সালের ১৪ জানুয়ারি: দুই বিচারপতির বিভক্ত রায় নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়। ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় বিচারপতির আদালতে শুনানি শুরু এবং ১৯ এপ্রিল শেষ হয়। ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারপতি রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির সাজা বহাল রেখে, খালাস দেন তিন আসামিকে। এরপর আটক সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি লিভ টু আপিল দায়ের করেন।
১৬ আগস্ট লিভ টু আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ছিল। এরপর আট বার শুনানি মুলতবি হয়।
২০০২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি : মামলাটির শুনানি আপিল বিভাগের কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯ মার্চ বিশেষ পিপি সিরাজুল হক শুনানি শুরুর আবেদন জানালে আপিল বিভাগের দুজন বিচারপতি বিব্রতবোধ করেন। ফলে শুনানির জন্য বিচারপতি সংকট সৃষ্টি হয়। ১৫ ডিসেম্বর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলিদের অব্যাহতি দেয় জোট সরকার।
২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মার্চ: দীর্ঘ এই সময়ে আপিল বিভাগে শুনানি হয়নি। ২০০৭ সালের ২০ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে বিচারপতি মো. হাসান আমীনকে নিয়োগ দেওয়ায় লিভ টু আপিল শুনানির সম্ভাবনা তৈরি হয়।
১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপর আসামি ল্যান্সার মহিউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৪ জুন আসামি ল্যান্সার মহিউদ্দিন জেল আপিল করেন। আগস্ট প্রধান বিচারপতি লিভ টু আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেন। বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন বিচারপতি মো. হাসান আমীন।
আগস্ট আসামিদের লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি শুরু। ২৩ সেপ্টেম্বর লিভ টু আপিলের ওপর ২৫ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।
২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির দিন নির্ধারনের জন্য আবেদন জানায়। চেম্বার বিচারপতি অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করে দেন। অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সমন্বয়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। অক্টোবর আসামিপক্ষের আইনজীবী আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১৫ অক্টোবর যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুরু করে আসামিপক্ষ।
নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুরু করে এবং ১১ নভেম্বর শেষ হয়। শুরু হয় আসামিপক্ষের আইনি ব্যাখ্যা।
১৯ নভেম্বর পাঁচ আসামির আপিল জেল আপিল খারিজ করে রায় দেওয়া হয়।
২০১০ সালের জানুয়ারি: ঢাকা জেলা দায়রা জজ আব্দুল গফুর পাঁচ আসামির মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন। জানুয়ারি : রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন আসামি বজলুল হুদা, কে এম মহিউদ্দিন(ল্যান্সার) মুহিউদ্দিন (আটিলারী। ১০ জানুয়ারি আসামি বজলুল হুদা মহিউদ্দিনের আইনজীবী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ১২ জানুয়ারি: আসামি সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খানের আইনজীবী পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ১৯ জানুয়ারি : পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান মুহিউদ্দিন আর্টিলারি।
সর্বশেষ আদেশ: প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে চার বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ ২৪, ২৫ ২৬ জানুয়ারি উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে গতকাল ২৭ জানুয়ারি আদেশ দেন। রায় পুনর্বিবেচনার সব আবেদন খারিজ করা হয়