Saturday, February 13, 2010

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক

ডাঃ কে.এম.মাসুদুর রহমান

সভাপতি

মোঃ আবদুস সালাম

সাধারণ সম্পাদক

Friday, February 12, 2010

অধিকাংশ দিন আত্মগোপনে থাকতাম: বাদী




কামরুল হাসান | তারিখ: ১৯-১১-২০০৯

বাড়ি চিনতে তেমন কোনো অসুবিধাই হলো না। নাম বলতেই একজন বললেন, ওই দেখেন, সামনে পুলিশ পাহারা, ওই বাড়িটিই তাঁর। বাড়ির সামনের আঙিনায় কয়েকজন পুলিশ আর জনা কয়েক লোক বসে। পরিচয় দিতেই একজন বললেন, স্যার তো এখন হিরো, খুব ব্যস্ত এখন। গণমাধ্যমের কর্মীদের ভিড়ে নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত করতে পারছেন না। ব্যস্ত তো হবেনই। কারণ, রাত পেরোলেই যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়। আর এই মামলার বাদী তিনি এফ এম মহিতুল ইসলাম।

মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজের উল্টো দিকে নম্বর সড়কের মুখের প্রথম তিনতলা বাড়িটার নিচতলায় স্ত্রী একমাত্র মেয়েকে থাকেন মহিতুল। টিভি চ্যানেলের দুজন সাংবাদিক বসে আছেন সকাল থেকে। তার আগে এসেছিলেন আরও দুজন। দুপুর ১২টা বেজে গেলেও পেটে কিছু পড়েনি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সকালে একবার ইনসুলিন নিয়েছেন। শেষমেশ কথা বলার সুযোগ মিলল।

প্রথম আলো: কেমন আছেন?

মহিতুল: কেমন আর থাকতে পারি! ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করার পর থেকে পুলিশের পাহারায় ছিলাম। প্রথম চার বছর বাড়িতে পুলিশ ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তুলে নেওয়া হলো।
প্রথম আলো: তারপর....

মহিতুল: এরপর শুরু হলো অত্যাচার। অধিকাংশ দিন বাড়িতে থাকতাম না। রাতে ঢিল পড়ত বাড়িতে। বলতে গেলে আত্মগোপনে থাকার মতো। অচেনা লোকজন খুঁজতে আসত। ফোনে ভয়ভীতি দেখাত। ভয়ে থানা-পুলিশের ধারেকাছেও যেতাম না। বাড়ির সামনে ফুলের টব ছিল, একদিন কে বা কারা সেটা নিয়ে গেল। একটা পোষা ছাগল ছিল, সেটাও লুট হলো। একেকবার মনে হতো আর বাঁচতে পারব না, কিন্তু সাহস হারাইনি। বুকে পাথর চেপে সময় পার করেছি।

প্রথম আলো: আর এখন....

মহিতুল: এখন সুদিন এসেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এখন আরামে ঘুমাতে পারি। এমন সময় আরও পার করেছি৭৫ থেকে৯৬ পর্যন্ত। অনেক বছর ধরে।
প্রথম আলো: ওই দিন আপনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলেন কেন?

মহিতুল: আমরা চার ভাইবোন। থাকতাম যশোরের মনিরামপুরে গ্রামের বাড়িতে।৭১- মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলাম।৭২- ঢাকায় এসেছিলাম বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিতে। তার আগে এসএসসি পাস করেছি। তখন মুখ্য সচিব ছিলেন রুহুল কুদ্দুস। তিনি চাকরির প্রস্তাব দিলেন। রাজি হয়ে গেলাম। তিন-চার দিনের মধ্যে চাকরি হলো শাখা সহকারী হিসেবে।

প্রথম আলো: সেখান থেকে ৩২ নম্বর......

মহিতুল: এর মধ্যে একদিন মুখ্য সচিবের অফিস থেকে একটি ফাইল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেই তিনি আমাকে পছন্দ করে তাঁর বাসভবনে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

প্রথম আলো: কী কাজ ছিল আপনার?

মহিতুল: ৩২ নম্বর ভবনের নিচতলায় অফিস, কাজ ছিল রাষ্ট্রপতির পক্ষে ফোন ধরা আর প্রটোকল করা।
প্রথম আলো: ওই রাতের ঘটনা কিছু বলবেন...

মহিতুল: সেদিন রাতে বাসার মিস্ত্রি মতিন আমাকে ঘুম থেকে জাগায়। জানায়, প্রেসিডেন্ট ডাকছেন। সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণ হয়েছে, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজেই নিচে নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ ফোনটিও আমিই ধরিয়ে দিয়েছিলাম। না, সে ফোনে কেউ আর সাড়া দেয়নি। বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বলছি, আমার বাড়ির সামনে গুলি হচ্ছে, তোমরা দেখো।উনি ওপরে চলে যান।

প্রথম আলো: তারপর কী হলো...

মহিতুল: ততক্ষণে ৩২ নম্বরের আশপাশে গোলাগুলি শুরু হয়েছে। একপর্যায়ে শেখ কামাল নিচে নামেন। তিনি নামতে না নামতেই কয়েকজন ঘাতক বাড়ির ভেতরে ঢোকে। তারা কামালকে হাত উঁচিয়ে থাকতে বলে। কিছু সময়ের তাদের ব্রাশফায়ারে আমার সামনেই নিথর হয়ে যায় কামালের দেহ। ওই গুলিতে আমি, ডিএসপি নুুরুল ইসলাম এসবির এক দারোগা আহত হই। আমরা পালাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। ঘাতকেরা আমাদের চুল ধরে টেনে লাইনে দাঁড় করায়। একপর্যায়ে ওপর থেকে বঙ্গবন্ধুর গলা শোনা যায়। তিনি চিত্কার করে বলছেন, ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’ সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ শোনা যায়।
প্রথম আলো: আর রাসেল..

মহিতুল: লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। রাসেল দৌড়ে এসে অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে ধরে। সে ভয়ে ভয়ে বলেভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো।আমি তাকে অভয় দিই। সময় একজন ঘাতক তাকে জোর করে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভবনের গেটের পুলিশ বক্সে নিয়ে বসিয়ে রাখে। তখন সে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল। একজন ঘাতক তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি বলে ওপরে নিয়ে তাকে গুলি করে। এটাই ওই বাড়ির শেষ হত্যাকাণ্ড।

প্রথম আলো: তার পর কী হলো?

মহিতুল: আমাদের রাত থেকে লাইনে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। সকাল ১০টা পর্যন্ত আমরা সবাই ৩২ নম্বরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার পা থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। এরপর আর্মির গাড়িতে করে আমাদের ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। সেখানে বিশেষ পাহারায় চিকিত্সা চলছিল।

প্রথম আলো: তারপর..

মহিতুল: তিন দিন পর ঢাকা মেডিকেলের ওয়ার্ডের পেছনের দিকের একটি জানালা দিয়ে পালিয়ে যাই। একজন নিরাপত্তারক্ষী আমাতে সহায়তা করেছিল।

প্রথম আলো: ধরার পড়ার ভয় করেনি....

মহিতুল: এরপর সেনা সদস্যরা আমাকে খুঁজতে শুরু করে। ছয় দিন পর যশোরে গ্রামের বাড়ি থেকে তারা আমাকে ঢাকায় ধরে আনে। গণভবনে তখন ঘটনার তদন্ত কমিশন কাজ করছিল। তারা আমাকেও আটক করে জেরা করে।

প্রথম আলো: আপনি কি ঘাতকদের নাম কমিশনের কাছে বলেছিলেন?

মহিতুল: না, বলিনি। তখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায়। মনে হয়েছিল এদের সবকিছু সাজানো, লোক দেখানো। কারণে তাদের জেরার জবাবে আমি কিছুই বলিনি। তখন খন্দকার মোশতাকের মুখ্যসচিব শাহরিয়ার জেড ইকবাল আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।

প্রথম আলো: চাকরিও করেছেন তো পরে....

মহিতুল: এরপর সরকারি চাকরি করেছি, এই দপ্তর থেকে ওই দপ্তরে। শিল্প বাণিজ্যে ছিলাম, সর্বশেষ ত্রাণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে ছিলাম। ২০০১ সালের এপ্রিল বিএনপি সরকার আমাকে চাকরিচ্যুত করে। এতদিন নিজের পরিচয় আড়াল করে চলেছি। অপেক্ষায় থেকেছি। আশা করি, ঘাতকদের সাজা কার্যকরের মধ্য দিয়ে সেই অপেক্ষার অবসান হবে

প্রথম আলো: মামলা করতে এত দেরি করেছিলেন কেন?

মহিতুল: (ত্বরিত জবাব) দেরি হবে কেন? ’৭৬ সালের ২৩ অক্টোবর একবার চেষ্টা করেছিলাম। সরকারের অনুমতি ছাড়াই লালবাগ থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে। এজাহারের বিবরণ শুনে ডিউটি অফিসার গালে এক চড় কষিয়ে বললেন, ‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি।সেই চড়ের ব্যথা আজও ভুলিনি। পরে মনে হয়েছে, তখন মামলা না হওয়ায় ভালো হয়েছিল। না হলে রায়ের কার্যকারিতা দেখে যেতে পারতাম না। হয়তো কেউ গুম করে ফেলত। সে চেষ্টাও হয়েছে।

প্রথম আলো: এরপর....

মহিতুল: সফল হলাম ১৯৯৬ সালের অক্টোবর। কোনো মতামতে নয়, নিজের মতো করে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করি ইতিহাসের কলঙ্কময় হত্যা মামলার এজাহার।

প্রথম আলো: আপনি কী চেয়েছিলেন?

মহিতুল: ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে নাএটা হতে পারে না। আমি মনে করেছিলাম যতদিন বেঁচে আছি আমার পক্ষে যা করার করে যাব। কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঋণ শোধ করতে পারব।
প্রথম আলো: এখন...

মহিতুল: এত দিন অপেক্ষা করেছিলাম সময়ের জন্য। সে সুবর্ণ সময় আমাদের জীবনে এসেছে। এখন অপেক্ষা ঘাতকদের সাজা কার্যকর দেখা। আমি মরেও শান্তি পাব।

কথার ফাঁকে ফাঁকে মহিতুলের ফোন বেজেই চলেছে। কোনোটা নিজে ধরছেন, কোনোটা পাশের কাউকে দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে একমাত্র শিশুকন্যা বাঁধন এসে এটা-সেটা বলছে। পুলিশের এক সদস্য বললেন, ‘স্যার, কাল অনেক কাজ। টিভি রেকর্ডিং, বঙ্গবন্ধু ভবনে যেতে হবে।অগত্যা এখানেই শেষ করতে হলো

***************************************************************************