Friday, February 12, 2010

রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান


২১ বছর পর মামলা, ১৩ বছর ধরে বিচার

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চূড়ান্ত রায় আজ

সাজ্জাদ শরিফ | তারিখ: ১৯-১১-২০০৯

দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য অপেক্ষা করছিল জাতি, তার হয়তো হয় তো অবসান হতে যাচ্ছে আজ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর রাতে সাবেক কর্মরত একদল সেনাকর্মকর্তার হাতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু-পরিবারের অধিকাংশ সদস্যও সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। বঙ্গবন্ধু-হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় দীর্ঘস্থায়ী ছেদ পড়ে। সমরতন্ত্রের ঘোর অমানিশায় তা পথ হারায়। একের পর এক আরও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে দেশ পাক খেতে শুরু করে। অগণতন্ত্রের গাঢ় প্রচ্ছায়া দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশকে গ্রাস করে। ঘোর অনিশ্চয়তা অস্থিরতা দেশকে টালমাটাল করে দেয়।

জাতির সেই কলঙ্কচিহ্ন মোচন হতে যাচ্ছে আজ। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর সুযোগ হয় মামলা দায়েরের। ১৩ বছরের দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ আজ দেবেন বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়।

বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর এক অচিন্তনীয় দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাঁর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়। এই আইন পরবর্তী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের সব পথ রুদ্ধ হয়ে থাকে। অধ্যাদেশ জারি করে দেশের সরকারপ্রধানের হত্যাকারীদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার এই প্রক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির গায়ে একটি রক্তাক্ত কাঁটার মতো এই অধ্যাদেশটি বিঁধে ছিল।সৈয়দ ফারুক রহমান খন্দকার আবদুর রশিদসহ এই হত্যাকাণ্ডের খলনায়কেরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করে রাজনীতির ময়দানে নামে। দেশে যাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি অঙ্কুর মেলতে না পারে, সেটা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সন্ত্রাসী তত্পরতা চালিয়ে রাজনীতির মাঠ তারা অস্থির করে রাখে। রাজনীতিতে ঠাঁই গাড়তে থাকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতির বিভক্তি সময়ে দৃঢ়মূল হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালেও এর ছায়া আমাদের রাজনীতিতে কম-বেশি দেখা যায়।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে, দুই দশক পরে, ১৯৯৬ সালে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। একই বছরের অক্টোবর এজাহার দায়ের করা হয় ধানমন্ডি থানায়। বঙ্গবন্ধু-হত্যার ২১ বছর পর সূচনা ঘটে বিচার-প্রক্রিয়ার।

নভেম্বর ১৯৯৮ তারিখে ঢাকা জেলা দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৯ জন আসামির ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামিদের ১১ জন ছিলেন পলাতক। এরপর মামলার আপিল-শুনানি হয় হাইকোর্টে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই মামলার দ্বিধাবিভক্ত রায় দিলে সেটি যায় তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের বেঞ্চে। তাঁর রায়ে ১২ জন আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে, তিনজনকে খালাস করে দেওয়া হয়। এর পরে বিএনপির শাসনামলে বিচার প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে যায়। অবশেষে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির সর্বশেষ পর্যায় শুরু হয়। টানা ২৯ কার্যদিবস শুনানির পর ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটবে আজ, আপিল বিভাগের নম্বর কক্ষে বেলা ১১টায়।

জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের অবসান ঘটাতে উন্মুখ বাংলাদেশ। রাষ্ট্র আজ ধুয়ে ফেলতে উদগ্রীব তার গায়ে লেগে থাকা রক্তের কলঙ্কচিহ্ন। রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হয়তো পথ খুলে দেবে আরও অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারপথ। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক বিতণ্ডার সমাপ্তি টানার একটি সুযোগও হয়তো আমাদের সামনে আসবে।
অতীত ইতিহাসই জাতির ভবিষ্যতের পথ রচনা করে। বঙ্গবন্ধু-হত্যা, হত্যা-পরবর্তী রাজনীতি এর বিচার-প্রক্রিয়া একটি সরল সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। সে সত্য হলো, সরকারের পরিবর্তন রাষ্ট্রের পরিচালনা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়েই হতে হবে।

আর কোনো হত্যাকাণ্ড বা অভ্যুত্থান যেন বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত না করে

***************************************************************************

*************************************************************************

No comments:

Post a Comment