Wednesday, October 6, 2010

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১০
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ৬৪তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৭ সালের এদিনে মধুমতি নদী তীরের প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ হাসিনার জন্ম। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার প্রথম সন্তান। তাঁর ডাক নাম হাসু। দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতি আদরের নাতনি হাসু। শৈশব-কৈশোর কেটেছে দাদা-দাদির কোলে-পিঠে মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁরা পাঁচ ভাই-বোন। কনিষ্ঠদের মধ্যে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। এদের মধ্যে শেখ হাসিনা এবং রেহানা ছাড়া কেউ জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই কালোরাতে পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মাতা ফজিলাতুন্নেছাসহ সবাই ঘাতকদের হাতে নিহত হন। পিতাকে খুব একটা কাছে না পেলেও শৈশব-কৈশোর আনন্দেই কেটেছে শেখ হাসিনার। গ্রামবাংলার ধুলোমাটি আর সাধারণ মানুষের সাথেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। গ্রামের সাথে তাই তাঁর নাড়ির টান অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে বারবার। শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পুরনো ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়ার বাসায় তাঁরা উঠেন। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। শুরু হয় তাঁর শহর বাসের পালা তথা নাগরিক জীবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ৬-দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬-দফা দাবিতে পূর্ববাংলায় এক অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসক গোষ্ঠী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাঁর জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর বিপদাশংকা ও দুঃসহ কষ্ট। এই ঝোড়ো দিনগুলোতেই বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দী অবস্থায় তাঁর প্রথম সন্তান ‘জয়’ এর মা হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যা সন্তান পুতুলের জন্ম হয়।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগে ছোটবোন শেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা ইউরোপ যান। বেলজিয়ামের রাজধানী হেগ-এ অবস্থানকালে তিনি বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরার কোন পরিবেশ না থাকায় তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনার পরবর্তী ইতিহাস একবিংশ শতকের অভিযাত্রায় তিনি কিভাবে বাঙালি জাতির কাণ্ডারি হয়েছেন তার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্ন রূপায়নের দায়িত্ব নিয়ে বাঙালি জাতির আলোর দিশারী হওয়ার ইতিহাস।
মাতৃভূমির ডাকে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন :
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনাবলীর পর তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর দেশে ফেরার কোন পরিবেশ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ তখন ছিল অলিখিত নিষিদ্ধ। সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসুক, তা চায়নি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী লীগেও চলছিল নেতৃত্বের শূন্যতা।
এমনি এক দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃবর্গ সর্বসম্মতিভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে এসে দলের দায়িত্বভার গ্রহণের অনুরোধ জানান। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর ঐ বছরেরই ১৭ মে দীর্ঘ ৬ বছরের প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা।
সংগ্রাম শুরু :
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে সমগ্র দেশব্যাপী শুরু হলো প্রবল আলোড়ন। বদলে গেল দৃশ্যপট। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাঁকে অভিনব সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।



২৮ সেপ্টেম্বর ২০১০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলের কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে ৯ দিনের সফর শেষে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতি পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা আমাদের নেই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিন্তু এ সত্য অস্বীকারের কোন উপায় নেই কেয়ারটেকার সরকারের নামে বিগত দুই বছরের অন্তর্বর্তী শাসনামলের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সবাই বিরক্ত।’ তিনি আরো বলেন, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ীই সবকিছু করা হবে। তবে ১৯৭৫ সাল-পরবর্তী সবগুলো সামরিক শাসনামল অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের দুটি যুগান্তকারী রায়ের প্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশের লক্ষ্যে বেশ কয়েক মাস আগে গঠিত সংসদীয় কমিটির কেয়ারটেকার পদ্ধতি সম্পর্কে সম্ভবত নিজস্ব পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে জরুরী আইনে আটক সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলা দায়েরে কৌশলগত সমস্যা থাকায় আদালতের নির্দেশেই তারা মুক্তি পাচ্ছে। তিনি বলেন, কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। যদিও প্রধান বিরোধী দল তাদের রক্ষায় নেমেছে। ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এটি কোন প্রতীকী বিচার নয়। কারণ তদন্ত শেষে আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। তিনি আরো বলেন, ‘আইন অনুযায়ীই তাদের বিচার করা হবে। আর এ জন্যই জনগণ বিশেষ করে তরুণরা আমাদের বিপুল ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আমরা ১৯৯০ সালে ‘গণআদালত’-এর মাধমে তাদের প্রতীকী বিচার করেছিলাম। এবার হবে তাদের সত্যিকার বিচার।’ শেখ হাসিনা বলেন, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার মতো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াও একটি দীর্ঘপ্রক্রিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কয়েক দশক সময় লেগেছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বিচারের জন্য ১১ হাজার সন্দেজভাজন যুদ্ধাপরাধীকে কারাগারে রাখা হয়েছিল। এছাড়া আরো ২২ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে মার্শাল ল’ ঘোষণা করে এসব অপরাধীদের ছেড়ে দেয়া এবং পুরো প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা নাগরিকত্ব নিয়ে জনগণের মাঝে ফিরে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করায় যে নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল, সামাজিকভাবে তাদের পুনর্বাসন করা হয়। আর এসবই করেছেন জিয়াউর রহমান। যদিও তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।’ মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশীদের পুরনো দাবী ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট পুনরায় চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিমান বোয়িং কোম্পানীর কাছ থেকে বিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১১ সাল নাগাদ তা পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিমান পাওয়ার পরপরই এ রুটে পুনরায় বিমান চালুর আশ্বান দেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে এ প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ বিষয়ে তার সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ দুটি পৃথক বিষয়। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু কোন দল নির্বাচনী রাজনীতির জন্য যোগ্য কি-না সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে।



(পূর্ণ ভাষণ)
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০
সম্মানিত সভাপতি,
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন।
আমি বিশ্বাস করি, আপনার প্রাজ্ঞ ও দৃঢ় নেতৃত্বে এই অধিবেশন সর্বাত্মকভাবে সফল হবে। ৬৪তম অধিবেশন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি ঐ অধিবেশনের সভাপতি ড. আলী আবদুস সালাম ট্রেকি-কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জাতিসংঘের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করার জন্য মহাসচিব মি. বান কি মুন-কে জানাচ্ছি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সম্মানিত সভাপতি,
৩৬ বছর আগে আমার পিতা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার সেবায় জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজও জাতিসংঘ সারাবিশ্বের বিপন্ন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের শেষ ঠিকানা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ একটি উদার, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাতিসংঘের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং দায়িত্ববান সদস্য। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের সকল উদ্যোগের প্রতি বাংলাদেশ পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
দেশ এবং দেশের বাইরে বৈরি শক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ করে, সন্ত্রাসবাদ দমনে, বাংলাদেশ কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব ব্যক্তি হত্যা, নারী ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের মত গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে আমরা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছি। আমাদের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সংক্রান্ত রোম ঘোষণার সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা। আমি বিশ্বাস করি, কেবল সুবিচারই পারে অতীতের অমার্জনীয় ভুলের নিরাময় করতে।
এ প্রসঙ্গে আমি স্মরণ করতে চাই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশে সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কথা। সেদিন সন্ত্রাসীরা আমার পিতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমার পরিবারের ১৮জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। আমার মা, তিন ভাই - শেখ কামাল, শেখ জামাল, দশ বছর বয়সের ছোট ভাই শেখ রাসেল ও দুই ভাইয়ের স্ত্রীকেও সেদিন হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর বার বার আমার উপর হামলা হয়েছে। বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত, যখন আমরা বিরোধীদলে ছিলাম তখন সংখ্যালঘুসহ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকারের সময়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আমার শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল; ২৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, আমার দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানও সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন। গুরুতর আহত পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী এখনও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার পরিবার বারবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করিনি। আমি পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই বাংলাদেশের মাটিতে আমরা কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেব না। এজন্য আমরা ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের সন্ত্রাস বিরোধী সকল কনভেনশনের অনুমোদন দিয়েছি। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি বলেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করে জাতিগত সংঘাত নিস্পত্তি করেছিলাম। ২০০৯ সালে শান্তিপূর্ণভাবে বিডিআর বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।



২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষ জাতিসংঘ পুরস্কার পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানকারী বিশ্ব নেতাদের সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বারাক ওবামা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কথা উদ্ধৃত করে বাসস'কে এ কথা জানান। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ সংবর্ধনার আয়োজন করেন। জাতিসংঘের ধার্যকৃত সময়সীমা২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা ও নেতৃত্ব এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য বাংলাদেশে এমডিজি পুরস্কার লাভের প্রশংসা করেন বারাক ওবামা।অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী কর্তকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য এগিয়ে যাওয়ার সময় বারাক ওবামা ছিলেন প্রাণোচ্ছ্বল ও আন্তরিক। শেখ হাসিনা তাকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।



২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে শিশু কল্যাণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নিবেদিত কার্যক্রমই মূল কারণ। তবে তহবিলের অভাবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আছে, আছে নিবেদিত ভূমিকা কিন্তু নাই অর্থ, এটাই সমস্যা। এখানে ৬৫তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশাপাশি বুধবার ‘চিলড্রেন এন্ড দি এমডিজি’স : রিচিং দ্য মোস্ট ভালনারেবল’ শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভায় তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ার একটি সমস্যা বাংলাদেশের রয়েছে। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতিসংঘের ধার্য সময়সীমার মধ্যেই বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। সিএনএন টেলিভিশনের প্রখ্যাত অনুষ্ঠান উপস্থাপক জিম ক্লানসি এই আলোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই বলে পরিচয় করিয়ে দেন ‘গোটা পরিবারের সদস্যরা ঘাতকদের হাতে বলি হলেও বেঁচে আছেন তিনি’ বলে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর ইউনিসেফের সভাপতি ও আগামী বছর সহ-সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সার্বিক নীতিমালা অনুসারে সংস্থার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সহজীকরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে ইউনিসেফের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউনিসেফ ঘরে ঘরে উচ্চারিত নাম। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহে ইউনিসেফ শিশুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া তিনি জাতিসংঘ শিশু তহবিলে যেসব দেশ, কর্পোারেশন ও ব্যক্তিবিশেষ কোটি কোটি ডলার প্রদান করছে তাদেরও প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জরুরী মানবিক পরিস্থিতি এবং শান্তিকালেও বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ ইউনিসেফের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার করতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, শিশুদের বাঁচার অধিকার, সুরক্ষা ও উন্নয়নের প্রাথমিক হেফাজতকারী ইউনিসেফকে সহ্রসাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দফাগুলো প্রত্যেক শিশুর জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কারণ ইউনিসেফেরই রয়েছে নৈতিক কর্তৃত্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা। এছাড়া ইউনিসেফের রয়েছে ড. অ্যান্থনি লেকের মতো অভিজ্ঞ নির্বাহী পরিচালক। প্রধানমন্ত্রী তাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘নতুন কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে আমি তার দৃঢ় নেতৃত্বের অপেক্ষায় থাকলাম।’ আজকের শিশুরা সাম্প্রতিক বিশ্ব মন্দা, বিশ্ব উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা স্থানান্তরের বিরূপ প্রভাবের শিকার এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গত ৮০ বছরের মধ্যে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দায় খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। পরিণামে বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকার হয়েছে শিশুরা। অনেক শিশুই ঝরে গেছে অকালে এবং অনেক শিশু বেঁেচ রয়েছে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালে শিশু পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিসেফ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে জনসংখ্যার ২.৭ শতাংশ কিংবা বাংলাদেশসহ ১১টি দেশের ৭কোটি ৮০ লক্ষ লোক স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ১ ডলারেরও কম ব্যয় করতে পারে। তবে সমকৌশলভিত্তিক নতুন পরিকল্পনার কারণে প্রতিবেদনটি আশা-আকাক্সক্ষাও জাগিয়ে তুলেছে। এসব পরিকল্পনা অনুমোদিত হলে বঞ্চিত শিশুদের উন্নয়ন ও এমডিজি সম্পর্কিত স্বাস্থ্য বিষয়ে অগ্রগতি অর্জিত হবে। এছাড়া এসব বঞ্চিত শিশুদের পারিবারিক ব্যয়ও হ্রাস করবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস কার্যক্রমে বর্তমানের তুলনায় খরচ কমে যাবে। এদিকে ইউনিসেফ ১৯৯২ সালে পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ে জাতিসংঘ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমডিজি অর্জনে সমতাভিত্তিক যে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা ‘আন্তঃপ্রজন্ম সমতা’র অনুরূপ তার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ এসব উদ্যোগ অনুমোদন করেছে। শেখ হাসিনা ইউনিসেফের কার্যক্রম বাস্তবায়নে কম মূল্যের কৌশল ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ১৯৮০’র দশকে প্রবৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, শিশুদের ডায়রিয়ায় খাবার স্যালাইন, বুকের দুধ খাওয়ানোসহ শিশুদের জীবনধ্বংসকারী ছয়টি মারাত্মক রোগের টিকার ক্ষেত্রে কম খরচের কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল। খাবার স্যালাইন আবিস্কার বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসার ইতিহাসে বড়ো ধরনের অগ্রগতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে শরণার্থী শিবিরে শিশুদের কলেরা চিকিৎসাকালে খাবার স্যালাইন আবিস্কৃত হয়েছিল। ইউনিসেফের সমতাভিত্তিক নতুন কার্যক্রম বাস্তবায়নে এ ধরনের কম মূল্যের কৌশলের প্রয়োজন রয়েছে। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যতোবার একটি শিশু জন্ম নেয় ততোবার আমি নতুন করে বিশ্বাস করি ঈশ্বর মানুষকে ছেড়ে যাননি’ এ উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন। তিনি এ উদ্ধৃতির বাস্তবতাকে অঙ্গিকৃত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।

No comments:

Post a Comment