Monday, August 2, 2010

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-০৫

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-০৫


যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী
 


আজ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে নিয়েই আমার আলোচনা 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে অভিযুক্ত যে ক’জন জামায়াতে এখনো আছেন , জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তাদের মধ্যে অন্যতম। তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালি হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা, রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দান এবং ধর্ষণ-নির্যাতনসহ নানা অপকর্ম চালানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মন্মথপুর গ্রামের মৃত খন্দকার লুৎফর রহমানের ছেলে মতিউর রহমান নিজামী জোট সরকারের আমলে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এএসএম সামছুল আরেফিন তার ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ বইয়ে লিখেছেন, নিজামী মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন (পৃ-৪২৭)। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট’-এ (সংক্ষিপ্ত ভাষ্য) বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালে এ জামায়াত নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। মতিউর রহমান নিজামী এই আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ... আলবদরের নেতারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করেন এবং তাদের নির্দেশে ডিসেম্বর মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে শত শত বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।’

নিজামী যে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বহু দলিল থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে নিজামী বলেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাকবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে (শত্রুবাহিনী) পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।’ (সূত্র : গণতদন্ত কমিশন রিপোর্ট)।

জাতীয় গণতদন্ত কমিশন রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান সংবলিত নিজামীর ভাষণ ও বিবৃতির বহু বিবরণ একাত্তরের জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়েছে। যশোর রাজাকার সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্য করে নিজামী বলেন, জাতির এ সংকটজনক মুহহৃর্তে প্রত্যেক রাজাকারের উচিত ঈমানদারির সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ওইসব ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে’ (পৃ ৫-৬)।

নিজামীর এলাকার লোকজনও নিজামীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, লুটতরাজ ও নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। যেমন ১৯৭১-এ ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তিনি আলবদর বাহিনীর একটি সমাবেশ ও গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মতিউর রহমান নিজামীও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কোথায় কোথায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আছে তা চিহ্নিত করা হয়। বৈঠকে নিজামী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, ঘাঁটি ধ্বংস এবং আওয়ামী লীগারদের শেষ করার নির্দেশ দেন। বৈঠকের পরদিন রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় বৃশলিকা গ্রাম ঘিরে ফেলে গোলাগুলি, নির্যাতন ও লুটতরাজ করে এবং বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় আলবদররা। নিজামীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে সাঁথিয়ার মিয়াপুর গ্রামের মোঃ শাহজাহান আলী গণকমিশনকে জানান, যুদ্ধের সময় তিনি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে আরো কয়েকজন আটক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার গলায়ও ছুরি চালানো হয়েছিল। অন্যদের জবাই করা হলেও শাহজাহান আলী ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। গলায় কাটা দাগ নিয়ে তিনি এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন (জাতীয় গণতদন্ত কমিশন রিপোর্ট, সংক্ষিপ্ত ভাষ্য পৃ.-৬)।

সাঁথিয়ার শোলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্ভর নিজামীর নির্দেশে এবং রাজাকার সাত্তারের নেতৃত্বে আলবদর ক্যাডাররা ধুলাউড়ি গ্রামে গণহত্যা চালায় এবং ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। বেড়া উপজেলার বৃশালিকা গ্রামের সোহরাব আলীকে মাওলানা নিজামীর নির্দেশে গুলি করে হত্যা করে রাজাকার বাহিনী। এছাড়া একই এলাকার প্রফুল্ল প্রামাণিক এবং তার ছেলে ষষ্টি প্রামাণিককে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে এবং তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।’ ওই ঘটনার কয়েকজন সাক্ষী রয়েছেন বলে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস জানান।

সাঁথিয়ার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজামীর নির্দেশে করমজা গ্রামে গণহত্যা চালায় জামায়াত নেতা সিরাজ ডাক্তারের ছেলে রফিকুন্নবী। এ ব্যাপারে ডা. সিরাজ ও রফিন্নবীকে আসামি করে ১৯৭২ সালে একটি মামলা হলেও পরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়।

সাঁথিয়ার মিয়াপুর গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বলেন, ‘নিজামীর প্রত্যক্ষ মদদে মুক্তিযোদ্ধা বটেশ্বর, চাঁদ, দারা, শাহজাহান, মোসলেম ও আখতারকে আলবদররা হত্যা করে। তারা মুক্তিযোদ্ধা কবিরের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।’ সাঁথিয়ার লোকজন জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করায় এলাকার লোকজন মতিউর রহমান নিজামীকে ‘মইত্যা রাজাকার’ বলেও ডাকেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যার পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে নিজামী মাওলানা সুবহান ও মাওলানা ইসহাকসহ পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরব যান। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর মাওলানা নিজামী পাকিস্তান হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজযোগে ঢাকায় আসেন এবং মগবাজারে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন।

সাঁথিয়ার ক্ষেতুপাড়া গ্রামের রমিজ উদ্দিন জামায়াতের সমর্থক। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের লুটপাট আর স্বজনপ্রীতির কারণে এখন জামায়াতের সমর্থক বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে।’

১৯৭১ সালে এই রাজাকার আলবদর আর আলশামস ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। সাড়ে চার লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে। আজ তাদের বিচার হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই যারা ভুক্তভোগী তাদের পরিবার পরিজন এই বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরম্নদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। সাধারণ ৰমা ঘোষণার পর ১১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি কারাগারে আটক ছিল। তাদের বিচার হচ্ছিল। কিনত্ম ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জিযাউর রহমান ৰমতায় এসেই দালাল আইন বাতিল করে দেন। শুধু বাতিলই নয় রাজাকারদের তিনি পুনর্বাসনও করেন। রাজাকার আলবদরদের মন্ত্রীও করা হয়।নিজামী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে সাঁথিয়ার জামায়াত নেতা-কর্মীরা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নানা নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাঁথিয়া উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা আবদুল মালেক, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী, আকমল হোসেন, বেড়া উপজেলা জামায়াতের আমির আবু দাউদ, মকসুদ আহমেদ চৌধুরী ও জামায়াত নেতা রফিকুন্নবী এলাকায় নিজামীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের সম্পর্কে কোনো অভিযোগই নিজামী কানে তোলেন না। তারা স্থানীয়ভাবে নিজামীর ৬ খলিফা হিসেবে পরিচত। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাঁথিয়া ও বেড়ায় সরকারি জায়গা দখল করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন নিজামীর সহযোগীরা। আলহেরা একাডেমী, ছোন্দহ কলেজ, জোড়গাছা কলেজ তার মধ্যে অন্যতম।

সাম্প্রতিক একাত্তরে মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী,বিরম্নদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল। কারাগারে আটক জামায়াতের এই শীর্ষ নেতাকে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানোর জন্য আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে করা এক আবেদনের ওপর সোমবার শুনানি শেষে এ পরোয়ানা জারি করা হয়। একই সঙ্গে ট্রাইবু্যনাল তার বিরম্নদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর হয়েছে কিনা তার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইবু্যনালের সদস্যগণ সোমবার এই আদেশ দেন। এই আদেশের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন হলো। 

তথ্য সূত্র:নেট থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন সালের বিভিন্ন নিউস পেপার ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বই 
Prothom Alo Logo

No comments:

Post a Comment