Wednesday, July 21, 2010

সংবিধান সংশোধনে সংসদে বিশেষ কমিটি গঠন
প্রধানমন্ত্রী বললেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখাই উদ্দেশ্য

সংসদে বিশেষ কমিটি ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী পিআইডি
সমকাল প্রতিবেদক
বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধনে ১৫ সদস্যের সংসদীয় 'বিশেষ কমিটি' গঠন করা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন এবং বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনে সংবিধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংসদে রিপোর্ট উপস্থাপনের জন্য কার্যপ্রণালী বিধির ২৬৬ ধারা অনুযায়ী এ কমিটি গঠন করা হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব এ কমিটিকে সংবিধান কার্যপ্রণালী বহির্ভূত বলে দাবি করেছেন। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে ১৫ সদস্যের এ বিশেষ কমিটির নাম প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদন হয়। চিঠি দেওয়ার পরও কোনো প্রতিনিধির নাম না পাঠানোর কারণে বিশেষ কমিটিতে বিএনপির কাউকে রাখা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ কমিটির নাম প্রস্তাব করে সংসদে বলেন, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী, সুসংহত ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অতীতে মার্শাল ল' এবং সামরিক ফরমান জারি করে যেভাবে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে তা পুনঃসংশোধন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে চায়।
ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের বিরতির আগে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংসদে রিপোর্ট দিতে কার্যপ্রণালী বিধির ২৬৬ ধারা অনুযায়ী বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব
করেন। বিরোধী দলবিহীন সংসদে ডেপুটি স্পিকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়।
সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। ১৫ সদস্যের এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন_ আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট রহমত আলী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, জাসদের হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী।
বিশেষ কমিটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান সংশোধনে এ কমিটি প্রয়োজনে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবে। কমিটির বৈঠকে তাদের ডাকতে পারবে। আলোচনাও করতে পারবে। বিশেষ কমিটি সংবিধান সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করলে সংসদের আগামী অধিবেশনে তা পাস হবে বলে জানিয়েছেন চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ। আজ সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষ হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রথমে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়েই বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী হওয়ায় সংবিধান সংশোধন কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি আগেই স্পষ্ট করা হয়েছিল সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে প্রতিনিধির নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও তারা কোনো নাম পাঠায়নি। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলকে বাদ রেখেই বিশেষ কমিটি গঠন করা হলো।
বিশেষ কমিটিতে একজন প্রতিনিধি চেয়ে চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের পাঠানো চিঠি নিয়ে রোববার গভীর রাত পর্যন্ত সিনিয়র নেতা ও আইনজীবীদের নিয়ে বৈঠক করেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। সেখানেই প্রতিনিধি না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং চিঠির পাল্টা জবাব পাঠায় বিএনপি। উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কমিটি গঠনের কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন রাখা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। চিঠিতে 'অস্পষ্টতার' তিনটি বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, 'সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির কোন ধারামতে এ কমিটি গঠন করা হচ্ছে, এতে জনগণের স্বার্থ কী এবং সংবিধানের কোন কোন ধারা সংশোধন করা হবে_ এসব কিছুই লেখা হয়নি।'
এদিকে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সংবিধান সংশোধনে সংসদীয় কমিটি গঠনকে অবৈধ এবং সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি বহির্ভূত বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, কার্যপ্রণালী বিধিতে সংবিধান সংশোধনে এ ধরনের সংসদীয় কমিটি গঠনের কোনো বিধান নেই। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধনের পথ থেকে সরে আসার জন্য সরকারি দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এভাবে জনগণের ওপর কিছু চাপিয়ে দিলে তার পরিণতি শুভ হবে না।
প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পবিত্র সংবিধান অর্জন করেছি। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের মূল দলিলই হচ্ছে এই সংবিধান। অথচ এই পবিত্র সংবিধানকে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর মার্শাল অর্ডিন্যান্স বা সামরিক ফরমান দিয়ে বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ মার্শাল ল' এমন একটি আইন যা সংবিধানে নেই। আর্মি রুলস ও রেগুলেশনেও নেই।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর সামরিক আইন জারি হয়। একজন সামরিক স্বৈরশাসক ২০ আগস্ট ফরমান জারি করে নিজেকে সামরিক প্রশাসক ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক আইনের ২৯২ এবং ২৯৩ বিধির কোথাও সামরিক আইন জারির বিধান ছিল না। এমনকি চাকরিরত অবস্থায় কোনো সামরিক ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিধানও ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, যে সংবিধান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে প্রস্তুতকৃত ও গৃহীত, সেই সংবিধানকে মার্শাল ল' জারি করে, সংবিধান ও আর্মি অ্যাক্ট লঙ্ঘন এবং অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করতে একের পর এক আইন লঙ্ঘন করে কীভাবে সংশোধন করা যাবে?
হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৫ সালে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে মার্শাল ল' জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এভাবে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানকে স্থগিত করে ক্ষমতা দখল এবং অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করতে কারচুপির নির্বাচন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে প্রজাতন্ত্রে তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী জনগণের ক্ষমতা আমরা জনগণের হাতে রাখতে চাই। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী, সুসংহত ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে মার্শাল ল' এবং জারি করা ফরমান বৈধ করতে যেভাবে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে তা পুনঃসংশোধন করা প্রয়োজন। হাইকোর্টের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আমরা গণতান্ত্রিক ধারার অভিযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাই।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সামরিক আইনে ক্ষমতা দখলের খেসারত দিয়েছে সেনাবাহিনী। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেনা ছাউনিতেই বিধবার কান্না দেখেছে দেশের জনগণ। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক, তা আমরা চাই না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যেসব দেশ সামরিক শাসনে পরিচালিত হয়েছে, তারা কখনও উন্নতি করতে পারেনি। বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে যেসব দেশ চলেছে, সেসব দেশ ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে পেঁৗছেছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। সেখানে সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকবে। গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত ও অব্যাহত রাখাই বর্তমান সরকারের কর্তব্য। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশের জনগণ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে আমাদের বিজয়ী করেছে ঐতিহাসিক কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য। এ ব্যাপারে আমরা আদালতের রায়ও পেয়েছি।
তিনি বলেন, আর যেন কখনও অবৈধ শাসন জনগণের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসতে না পারে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, সেজন্যই সংবিধান সংশোধন একান্তভাবেই প্রয়োজন।


No comments:

Post a Comment