Saturday, July 31, 2010



শুরু হলো কান্নার মাস আগষ্ট!



শুরু হলো কান্নার মাস আগষ্ট। পনের আগস্ট বাঙালির কান্নার দিন। জাতির পিতার হন্তারণের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের সমান রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ দেহে স্তম্ভিত বাংলার সবুজ প্রাণ, পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্রের জলধারায় স্নাত আজন্ম কান্নার ইতিবৃত্ত। তাঁর প্রিয় কালোপাইপ হাতে নিজের রুমে পায়চারি করতে করতে যখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার চিন্তায় মগ্ন ঠিক তখনই ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে রক্তাক্ত হয় তাঁর বুক- বাংলাদেশের সমান হৃদয়। যে স্পর্ধা দেখাতে সাহস পায়নি পাকিস্তানি জান্তারা সেই স্পর্ধার সুপরিকল্পিত চিত্রপট- স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস।


বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা কী ভাবে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো- সে ইতিহাস হয়তো আজ সবার জানা, তবু বছরের অন্যান্য মাসের চেয়ে দিনের চেয়ে আগষ্ট আর তার পনের তারিখ আসলে আসলে মন বেশি ভারাক্রান্ত হয়। বারবার সেই মর্মদন্ত কাহিনী ফিরে আসে নতুন কষ্টের আকর হয়ে। 


পঁচাত্তরের পনের আগস্ট ভোরে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের স্কোয়াড্রন কমান্ডার একেএম মহিউদ্দিন তার সঙ্গীসহ বত্রিশ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ‘হ্যান্ডস আপ’ শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে অবিরাম গুলি বর্ষণে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ফোর্স নিয়ে সে দোতলায় উঠে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত করে। 


বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে বালুরমাঠে নাইট ট্রেনিংয়ের নামে যে প্রস্তুতিপর্ব সংগঠিত হয়েছিল তার কমান্ডিং অফিসার ছিল মেজর ফারুক এবং ঘাতক একেএম মহিউদ্দিন। পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার রাঙ্গাবালী গ্রামের আবুল হোসেন তালুকদারের পুত্র একেএম মহিউদ্দিন ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পায়। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সে সেখানেই কর্মরত ছিল। ৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে আটক থাকার পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পরও খুনি মোস্তাক ও পরবর্তী সরকারসমূহের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মহিউদ্দিন ৭৬ সালের ১০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। যদিও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দুপুরে খোন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভার শপথের সময় খুনি মহিউদ্দিন উপস্থিত ছিল। ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই তৎকালীন সরকার আলজিরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে তার চাকরি ন্যস্ত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পুরস্কারস্বরূপ সে এই লোভনীয় চাকরির সুযোগ পেয়েছিল সেটি ওপেন সিক্রেট। 


বঙ্গবন্ধুকে যখন ল্যান্সারখ্যাত ঘাতক মহিউদ্দিন সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসে তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় বলেছিলেন- ‘তোরা কী চাস?’ কিন্তু খুনিরা তখন রক্তের নেশায় মত্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ কথা শেষ না হতেই ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং মেজর নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বুকে ব্রাশফায়ার করে। বঙ্গবন্ধুর দেহ সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়ে। মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর তারা দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে দ্রুত বের হবার অব্যবহিত পরেই মেজর ফারুক একটি ট্যাংক নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে এবং পুরস্কারস্বরূপ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অনুগামী সেনাদের ঘাড়ে পদোন্নতির নতুন ব্যাজ পরিয়ে দেয়। 



১৯৭৫ সালের ১২ নভেম্বর মোস্তাক সরকার ইতিহাসের এই জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করতে যখন ইনডেমনিটি জারি করে, তখন বিশ্বাসী হতবাক হয়ে যায়। দীর্ঘ একুশ বছর পর শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সেই কালোআইনটি বাতিল করলে জাতি আবার পিতা হত্যার বিচারে নতুন আশায় জেগে ওঠে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ২৩ জনকে আসামি করে ধানমণ্ডি থানায় মামলা হয়। এরপর গত হয় বহু বছর। সম্পন্ন হয় হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্য। তবু সব আসামীদের শাস্তির রায় আজও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।


পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছিল। সেদিন স্বাধীনতার আদর্শকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল তারই কুফল আজও ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ। দিনে দিনে বেড়েছে দুর্বৃত্তায়। খুনিদের পুরস্কৃত না করে যদি সঠিক বিচার করা হতো তাহলে বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়নের প্রশ্রয় হতো না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে পারত না। 


বঙ্গব্ন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবায়নে সেই পঁচাত্তরের পনের আগস্টের শত্রু নিঃশ্চিহ্ন করার কাজ পুরোপুরি শেষ করতে হবে। যেভাবেই হোক পলাতক খুনিরা যে দেশে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তাদেরকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে যথাযথ শাস্তি বিধান করতে হবে। তা না হলে দুর্বৃত্তায়ন এবং তার ফলাফল বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মুখ থেকে দৃষ্টি ফেরানো কখনোই সম্ভব হবে না। সম্ভব নয়!


তথ্য সূত্র:prothom-aloblogprothom-alo prothomaloblog

No comments:

Post a Comment